গল্প হলেও সত্যি:Rudra Arrived

গল্প হলেও সত্যি


সময় টা ১৯৯৬ সালের ১০ জুন সোমবার।চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।আজ সারাদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিলো,তবে এখন বেশ জোরে বৃষ্ট পড়ছে সেই সাথে ঘন ঘন বিদুৎ চমকাচ্ছে।রাত তিনটা বিশ,রেহানা বেগমকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে,এক জায়গায় শান্ত হয়ে বসতে পারছে না।পারবেই বা কেমনে,তার বোন জাহানারা বেগমের বেবি ডেলিভারির সময় হয়ে এসেছে,কিন্তু এখনো কোনো ডাক্তারের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না,জাহানারার হাসবেন্ড জনাব আতিক সাহেব দু-তিন বারের মতো ড. শামসুর নাহার কে খবর পাঠিয়েছেন কিন্তু তার পরেও তিনি আসছেন না।সরকারী হাসপাতালের এই এক সমস্যা,বড় কারো হাত না দেখালে নড়তে চাই না।তবে রেহানা বেগম তার হাসবেন্ড কে দিয়ে ডাক্তারনী কে নড়াতে পারলেনে।নড়বারই কথা,কারন তার হাসবেন্ড জনাব ইরফান উদ্দিন আর যেনো তেনো কেউ না;তিনি রেলওয়ের একজন বড় কর্মকর্তা।অবশেষে ডাঃ শামসুর নাহার আসলেন এবং কর্মরত নার্সদের বললেন রোগী'কে ডেলিভারি রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
১১ জুন ভোর চারটা বারো,জাহানারা এবং আতিক এর ঘরে মুখ উজ্জ্বল করে নই,বরং মুখ কালো করে জন্ম নিলো কালো কুচকুচে একটি সন্তান।তাও সবাই অনেক খুশি।এই তাদের ছোট সন্তান।কিন্তু এখনো কেউ জানতে পারছে না সন্তানটি ছেলে না মেয়ে।কারন ডাক্তাররা কিছুই বলছে না এখনো।তাদের মুখে চিন্তার ছাপ,কয়েকজন নার্স এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে।ডাক্তারদের ছটফটানি দেখে রেহেনা বেগম এগিয়ে গেলেন ডাঃ. শামসুর নাহারের দিকে এবং তাকে জিজ্ঞেস করলেন,"ম্যাডাম কোনো সমস্যা,বাচ্চার মা সুস্থ আছেন তো??,নাকি বাচ্চার কিছু হয়েছে"এই বলেই তিনি প্রায় কেঁদে ফেল্লেন।"আরে না বাচ্চার মা সুস্থই আছেন,তবে এখনো জ্ঞান ফিরেনি,তবে বাচ্চাটি কি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে,বাচ্চাটি এখনো কেঁদে উঠে নি,হার্টবিটও তেমন পাওয়া যাচ্ছে না,চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে একটি ইঞ্জেকশন দেওয়া লাগবে না হলে বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে,বাচ্চাটিকে আমরা এখন অবজারভেশন রুমে রেখেছি,এই নিন ইঞ্জেকশনটির নাম,এটি দ্রুত আনার ব্যবস্থা করুন।" এই বলে ডাক্তারনী চলে গেলো।রেহেনা বোবার মতো দাড়িয়ে রইলেন,মাথার উপর যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো,কি করবেন বুঝতে পারছেন না, কাদবেন না বসে পড়বেন।এদিকে আতিক এর কোনো খোজ পাওয়া যাচ্ছে না।এতটা দায়িত্বহীন কীভাবে হয় একটি মানুষ,আজ তার স্ত্রীর ডেলিভারি অথচ তার কোনো খোজ খবর নেই।ভাবতেই গা রি রি করে উঠলো রেহানা বেগমের।বাবাকে শত মানা করা সত্ত্বেও এই ছেলেটির সাথে বিয়ে দিয়েছে।যা হোক ,মাথা থেকে এসব এখন একদম বের করতে হবে,আগে বোনের সন্তানের জীবন বাচাতে হবে।
১১ জুন সকাল দশটা তেইশ,জনাব আতিকুর রহমান ইঞ্জেকশনটির জন্য মরিয়া হয়ে সবখানে খুজে যাচ্ছেন।মনে মনে মেডিকেল কর্তৃপক্ষকে ভালোভাবে দুষছেন,এত বড় একটা মেডিকেল হাসপাতাল এখানে নাকি সামান্য একটা ইঞ্জেকশন নেই,তবে সামান্য বললে ভুল হবে,ইঞ্জেকশনটি অনেক দামী এবং দুর্লভ।আতিক সাহেব ইঞ্জেকশনটি খুজতে খুজতে অনেক দূর চলে এলো।আশেপাশে অনেক শব্দ দূষণ,আগামী কাল সপ্তম জাতীয় নির্বাচন,তা নিয়ে মিঃ রাজনীতিবিদ'রা যেখানে সেখানে ভাষণের মেলা খুলে রেখেছে।স্থানীয় নেতাদের উচ্চ তরঙ্গ বিশিষ্ট ভাষণও শোনা যাচ্ছে,ভাষণের বক্তব্য শুনে আতিক সাহেবের মাথা আরো নষ্ট হয়ে গেলো।খুব তো নির্বাচনের আগে মিহি মিহি কথা বলে,কিন্তু সেই মিহি মিহি কোকিলের কন্ঠ নির্বাচনের পর বাক বাকুম পায়রা হয়ে যাই।খুব তো ভাষণের সময় এই চট্টগ্রাম কে এম এ আজিজ এর চট্টগ্রাম,জহুর আহমেদ চৌধুরীর চট্টগ্রাম।অবশ্য এ ক্ষেত্রে চৌধুরী নিজের ঢোল নিজে বেশী বাজান।বাজাতে তে হবেই,মেয়র বলে কথা।আচ্ছা ভাষণের সময় এরা শুধু এদের কথা কেনো বলে,নারী বিপ্লবী  প্রীতিলতা ওয়েদ্দাফির কথা কেনো বলে না,কেনোই বা মাস্টার দা সূর্যসেন এর কথা বলে না।আচ্ছা ভাষণ যারা দিচ্ছে তাদেরকে ইঞ্জেকশন এর কথা বললে কি হয়।একটা ইঞ্জেকশন একটা ভোট।
অবশেষে আতিকুর রহমান সাহেব ইঞ্জেকশনটি খুজে পেলেনমেডিকেল থেকে ৫ কিমিঃ দূরে।কখন যে চলে আসলেন এত দূরে টেরই পেলেন না।বাঁ হাতের ক্যাসিও (মডেল ১৩৩২) ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই থ হয়ে গেলেন;দুপুর একটা দশ।অনেক দেরী করে ফেলেছেন।শীঘ্রই ফেরা দরকার
আতিক সাহেব হোমতি দোমতি হয়ে মেডিকেল এ ফিরলনে।শামসুর নাহার এর নিকট ইঞ্জেকশন জমা দিলেন।শামসুর নাহার ইঞ্জেকশনটি বাচ্চাটিকে পুশ করে চলে গেলেন,সেই সাথে নার্সদের বললেন বাচ্চাটি কে আরো পাচ ঘন্টা অবজারভেশন এ রাখার জন্য।যাওয়ার সময় রেহানা বেগমকে বলে গেলেন রেস্ট নেওয়ার জন্য এবং তার বোনে জ্ঞান ফিরেছে তাকে দেখে আসার জন্য।তবে রেহানে বেগম গেলেন না,কারন হাসপাতালে বাচ্চা চুরি হয়ে যাই সেই সম্পর্কে তার খুব ভালো ধারণা আছে।তাই তিনি আতিক কে বল্লেন জাহানারা কে দেখে আসতে।এবং তিনি সেখানে বসে রইলেন।দুপুর দুইটা পনের ,রেহানা বেগমের খুব ঘুম ঘুম পাচ্ছে,ভিষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে।সারা রাত জেগে রয়েছেন একটুর জন্যও  কোথাও বসেন তিনি।একটু ওয়াশরুমে যেতে হবে,কিন্তু কাউকে দেখছে না,কার ভরসায় বাচ্চাটিকে রেখে যাবে,আতিক সেই কবে গেছে যে এখনো ফেরার নাম নেই।কিন্তু তার যাওয়াটা খুব জরুরী,যা হোক আল্লাহর ভরসায় রেখে গেলো।অবজারভেশন রুমের সোজা গিয়ে ডান দিকে একটা ওয়াশরুম আছে,গন্তব্য সেখানের।করিডর দিয়ে যখন হেটে হেটে আসছিলো তখন ওয়াশরুমের পাশে এসে দেখতে পেলো কয়েকজন আয়ার দল বেধে বসে আড্ডা মারছে।রেহানা কে দেখে তারা কতক্ষণ চুপ হয়ে গেলো,সবার কটু দৃষ্টি তার দিকেই।দল থেকে একজন হ্যাংলা করে আয়া রেহানা বেগম কে দেখে উঠে দাঁড়ালো।রেহানা এত দিকে মনোযোগ না দিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুখে গেলো।কিন্তু তার মনটা কেমন ধুক ধুক করছে,বার বার ভাবতে লাগলো,আচ্ছা আয়াটা  তাকে দেখে হঠাৎ এভাবে উঠে দাড়ালো কেনো।নিশ্চয়ই কি এর পিছনে কোনো হেতু আছে,তাহলে কি তিনি যা ভাবছেন তাই।ওয়াশরুম থেকে সাথে সাথে বের হয়ে এক দৌড়ে চলে গেলো অবজারবেশন রুমের দিকে।সেখানে গিয়ে দেখলো সেই আয়াটি কোলে একটি বাচ্চা নিয়ে পালাবার চেষ্টা করছিলো,কিন্তু রেহানা বেগম তাকে  হাতে নাতে ধড়লেন,এক চিৎকার দিয়ে পুরো তৃতীয় তালার প্রত্যেক মানুষকে ডেকে ফেললেন,স্টাফ রুম থেক ডাঃ শামসুর নাহার,কিছু নার্স,রোগীর কিছু আত্মীয়স্বজন  ছুটে এলেন।আয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায় সে টাকার বিনিময়ে কাজটি করেছে।আয়াটিকে প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হলো।সবাই রেহানা বেগমকে বাহবা দিতে লাগলেন,বাহবা পাওয়ার মতোই কাজ করেছেন তিনি।শুধু বাহবা নই সেই বুদ্ধীমতীর পরিচয় তিনি দিয়েছেন।কারণ শামসুর নাহার যখন ইঞ্জেকশন দিচ্ছিলেন তখন বুদ্ধী করে রেহেনা বেগম তার বোনের বাচ্চাটিকে দেখে রেখেছেন।এতকিছু হয়ে গেলো কিন্তু আতিক এর কোনো দেখা এই পর্যন্ত পাওয়া গেলো না।
দুপুর বাজে তিনটা,বাচ্চাটির জ্ঞান ফিরেছে,আতিক সাহেবও এসেছেন।বাচ্চাটিকে জাহানারা বেগম এর পাশে এনে শুয়ে দেওয়া হয়েছে।জাহানারা বেগম দেখে অনেক খুশী মনে হচ্ছে।জাহানারা বেগম তার বোনের এই ঋণ যেনো কখনোই শোধ করতে পারবে না,কৃতজ্ঞতায় তার চোখ ভিজে গেলো,চোখ থেকে এক ফোটা পানি বাচ্চাটির কপালে পড়লো।মনের অজান্তেই বাচ্চাটি হেসে উঠলো,কালো হলেও তার চেহেরায় অনেক মায়া রয়েছে।
[প্রথম প্রকাশঃ১১ জুন ২০১৬ ফেইসবুক এ]

Comments

Popular Posts